ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব // দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম

পবিত্রতা হলো ইবাদত বন্দেগীর পূর্ব শর্ত । আসুন পবিত্রতা অর্জনের কিছু খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হই :
ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব:-
ইসলাম মানুষের পূতপবিত্র জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব
দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ’ (সহিহ মুসলিম: ২২৩)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘… আর পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৯)
পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলার ব্যাখ্যায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া নেক কাজের অন্যতম ভিত্তি, যা রুচিশীল ব্যক্তির রুচির দাবি। বিশেষত, যার মধ্যে মালাকুতি (ফেরেশতাসুলভ) নূর প্রসার লাভ করেছে, তারা অপবিত্রতা অপছন্দ করে এবং পবিত্রতা পছন্দ করে। তাতে আনন্দ ও প্রশান্তি বোধ করে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা-১৭৩)
‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’ হাদিসের ব্যাখ্যায়—শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘এখানে ঈমান দ্বারা অন্তরের সেই অবস্থা বোঝানো হয়েছে, যা পবিত্রতা ও নম্রতার নূরের সমন্বয়ে গঠিত। ..পবিত্রতা অন্তরের অন্তর্মূলে প্রভাব বিস্তার করে। তা আত্মাকে পূতপবিত্র করে, নির্মল করে এবং তাকে ফেরেশতাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। অনেক নোংরা ও নাপাক অবস্থা বিস্মৃত করে দেয়। মূলত অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যকে অজুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা-১৭৪)
তাহারাত:-
আভিধানিক অর্থে তাহারাত হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।
শরীয়তের পরিভাষায় অপবিত্রতা ও নাজাসাত দূর করা।
তাহারাতের প্রকারভেদ:-
আত্মিক তাহারাত
আর তা হলো শিরক, পাপাচার ও যা কিছু অন্তরকে কলুষিত করে তা থেকে পবিত্রতা। হৃদয়ে শিরকের উপস্থিতি বজায় রেখে কখনো তাহারাত অর্জন করা যায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা অপবিত্র, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর। আর যদি তোমরা দারিদ্র্যকে ভয় কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ অনুগ্রহে তোমাদের অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।} [সূরা আত তাওবা: ২৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন কখনো অপবিত্র হয় না। (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
বাহ্যিক তাহারাত-
আর তা হলো শরীরকে নাপাকি অবস্থা ও নাজাসাত থেকে পবিত্র করা।
তাহারাত দু’প্রকার::-
১। নাপাকি অবস্থা থেকে পবিত্রতা।
নাপাকি অবস্থা বলতে বুঝায়, শরীরে এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া, যার কারণে যেসকল ইবাদতে তাহারাতের শর্ত রয়েছে তা আদায় করতে না পারা। যেমন, নামাজ, পবিত্র কাবার তাওয়াফ ইত্যাদির জন্য তাহারাত শর্ত।
আর এ নাপাকি অবস্থা দু’প্রকার:
ছোট নাপাকি অবস্থা:-
তা হলো যা সংঘটিত হলে অজু করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেমন পেশাব, পায়খানা ও অন্যান্য অজু ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ। অজুর মাধ্যমে এ ধরনের নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জন করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাজে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত কর।} [সূরা আল-মায়েদা : ৬]
বড় নাপাকি অবস্থা:-
তা হলো যা গোসল ফরজ করে দেয়। যেমন সঙ্গমজনিত নাপাকি, মাসিক ঋতু ইত্যাদি। এ থেকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হলো গোসল। আল্লাহ তাআলা বলেন, (আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও।) [সূরা আল মায়েদা: ৬]
২। নাজাসাত থেকে পবিত্রতা অর্জন।
নাপাক-ময়লা দূর করা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র করো|} [সূরা আল মুদ্দাসসির : ৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,‘অধিকাংশ কবরের আযাব হয়ে থাকে পেশাবের অপবিত্রতার কারণে।’ (বর্ণনায় ইবনে মাজাহ)
তিনি আরো বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে আসবে তখন সে যেন দেখে নেয়, যদি তার জুতোয় ময়লা-নাপাকি থাকে তাহলে সে যেন তা দুর করে নেয় এবং সে জুতো নিয়েই নামাজ আদায় করে।’ (বর্ণনায় আবু দাউদ)
পানি:
পানির প্রকার
প্রথমত: পবিত্র পানি
তা হলো এমন পানি, নাপাক ময়লা যার রং বা স্বাদ অথবা গন্ধ পরিবর্তন করে দেয়নি, যেমন:
১। স্বাভাবিক পানি।
আর তা হলো এমন পানি যা তার সৃষ্টিগত চরিত্র ধারণ করে আছে। হোক তা আকাশ থেকে বর্ষিত যেমন, বৃষ্টি কিংবা বরফ বা শিলা। অথবা জমিনে প্রবহমান পানি যেমন সাগরের পানি, নদীর পানি, বৃষ্টির পানি, কূপের পানি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَأَنزَلۡنَا مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ طَهُورٗا) {আর আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি।} [সূরা আল ফোরকানঃ ৪৮]
আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَيُنَزِّلُ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ ) {এবং আকাশ থেকে তিনি তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এর দ্বারা তোমাদেরকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে।} [সূরা আল আনফাল : ১১]
আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করার সময় বলতেন, ‘হে আল্লাহ আপনি বরফ, পানি আর শিলা দ্বারা আমার পাপ থেকে আমাকে ধুয়ে ফেলুন।’ (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
তিনি সাগরের পানি সম্পর্কে বলেছেন,‘তার পানি পবিত্র আর তার মৃত হালাল।’ (বর্ণনায় আহমাদ ও আবু দাউদ)
২। ব্যবহৃত পানি।
তা হলো অজু বা গোসলকারীর অঙ্গ স্পর্শ করে পতিত হওয়া পানি। পবিত্রতা অর্জনের জন্য এ পানির ব্যবহার দোষনীয় নয়। ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন স্ত্রী একটি পাত্র থেকে গোসল করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে পানি দিয়ে অজু করতে গেলে তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ আমি তো অপবিত্র ছিলাম। তিনি বললেন, পানি অপবিত্র হয় না।’ (বর্ণনায় তিরমিযী )
৩। যে পানির সাথে পবিত্র বস্তু মিশ্রিত হয়েছে।
আর তা হলো এমন পানি যাতে কোনো পবিত্র বস্তু মিশে গেছে। যেমন গাছের পাতা বা মাটি অথবা মরিচা, যেমন পানির ট্যাংকিতে জমে-থাকা মরিচা। এগুলো যদি পানিকে এমন পরিবর্তন করে না দেয় যার কারণে পানিকে পানি বলে অভিহিত করা যায় না। এর প্রমাণ, যে সকল মহিলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেয়েকে গোসল করাচ্ছিলেন তাদের তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তাকে পানি ও কুল পাতা দিয়ে গোসল করাও তিনবার বা পাঁচবার কিংবা তার চেয়ে বেশি – তোমরা যদি ভাল মনে কর- আর শেষে কর্পূর লাগিয়ে দাও।’ (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
পানি পরিবর্তিত হওয়া:-
পানি যখন অন্য কিছুর প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে ভিন্ন নামে অভিহিত হয়, তখন সে পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা শুদ্ধ নয়। যেমন চা, শরবত ইত্যাদি। কেননা তখন এটাকে পানি নামে অভিহিত করা হয় না।
আর তা হলো এমন পানি যার মধ্যে কিছু নাপাকি পড়েছে, যেমন পেশাব বা মৃত প্রাণী ইত্যাদি। কিন্তু এটা পানির কোনো গুণকে পরিবর্তন করেনি।
৪। এমন পানি যার সাথে নাপাকি মিশ্রিত হয়েছে কিন্তু পানিকে পরিবর্তন করেনি।
এ পানি পবিত্র। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুযাআ কূপ সম্পর্কে বলেছেন, ‘পানি হলো পবিত্র, কোনো কিছু এটাকে অপবিত্র করে না।’ (বর্ণনায় আহমাদ ও তিরমিযী)
অর্থাৎ লোকেরা এই কূপের পাশে ময়লা আবর্জনা রেখে দিত আর বৃষ্টি সেগুলো কূপে নিয়ে যেত। কূপে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে এ সকল নাপাকি পতিত হওয়ার কারণে পানিতে কোনো প্রভাব বিস্তার করত না এবং পানি পরিবর্তিত হত না।
দ্বিতীয়ত: নাপাক পানি :-
তা হলো এমন পানি যার মধ্যে কোনো নাপাকি পতিত হয়েছে, যেমন পেশাব বা মৃত প্রাণী। এর ফলে পানির গন্ধ, স্বাদ, রং এ তিনটি গুণের একটি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এ পানি সর্বসম্মতভাবে নাপাক। এটা ব্যবহার করা জায়েয নয়।
মাসায়েল :-
পানির মৌলিক গুণ হলো পবিত্র হওয়া। তাই যদি কোথাও এমন পানি পাওয়া যায়, যা পাক না নাপাক, তা জানা না থাকে, তবে তা পবিত্র বলেই ধরতে হবে। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।
যমযমের পানি দিয়ে অজু করা জায়েয। কারণ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত, ’তিনি যমযমের এক বালতি পানি তলব করেছেন। অতঃপর তা থেকে তিনি পান করেছেন ও অজু করেছেন।’
Leave a Reply

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের সম্মানে চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত
