শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম
(বই পর্যালোচনা : গাজা উপত্যকার গল্প ) পরাবাস্তব জীবনের মোহে : মুনীর আল মুসান্না সময়ের দশে দশ– মুনীর আল মুসান্না ধামইরহাটে তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশকে সফল করতে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রস্তুতি সভা তেরখাদা উপজেলা বিএনপির মতবিনিময় ও সাংগঠনিক সভা অনুষ্ঠিত ধামইরহাটে ওয়ার্ল্ড ভিশনের আয়োজনে শিশুদের জন্মদিন উদযাপন বসুন্ধরায় নারীচক্রের ভয়ংকর ফাঁদ — ১১ বছর ধরে পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল! ঐতিহ্যবাহী শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির রবিউল হোসেন সভাপতি নির্বাচিত হাজারো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত যুবদল নেতা পিন্টু এক্সিডেন্ট চলবেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক চার বা ছয় লেন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দাওয়াতি পক্ষ গণসংযোগে লোহাগাড়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ

শিকড়ের সন্ধানে// বিজয়ের শুভ সূর্যোদয়//মোস্তফা ইউসুফ আলম

মোস্তফা ইউসুফ আলম, বিশিষ্ট লেখক ইসলামী আলোচক, কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা / ৮০ টাইম ভিউ
আপডেট: রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

বিজয়ের শুভ সূর্যোদয়
মোস্তফা ইউসুফ আলম

হক ও বাতিলের লড়াই চিরন্তন। থেমে থাকেনি কখনো হকের প্রদীপ নিভানো বাতিলের ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে হকের প্রদীপ মিট মিট করে জ্বলেছে বটে তবুও কখনো একটি মুহূর্তের জন্যও নিভেনি কভু। পক্ষান্তরে বাতিল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে যতবার বুদবুদের মতো নিভেও গেছে ততবার। আর এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। প্রত্যেক নবী (আ.) হকের পয়গাম সাথে নিয়ে আপন জাতির সামনে পেশ করলেন সামগ্রিক জীবনের চির কল্যাণকর এক শাশ্বত জীবনবিধান। হলে কি হবে শেষ পর্যন্ত ফল দাঁড়ালো এই যে, জাতির নানা প্রকার বিরোধিতা ও অত্যাচারের তাণ্ডবে এই মহা সত্যের নায়কদের কারও বা আশ্রয় নিতে হলো অগ্নি কুণ্ডলিতে, আবার কারও সাগর চিরে দেশান্তর হতে হলো, আবার কেউবা ঝাঁপ দিলো সাগরে। কারও ভাগ্যে জুটল নির্যাতনে ভরা কারাগার। কেউবা মহান চরিত্রের ওপর মিথ্যা কলঙ্কের দায়ে নিক্ষিপ্ত হলো কারাভ্যন্তরে। আবার অনেকেই শাহাদাতের খুন সাথে নিয়ে হাজির হলেন মহান প্রভুর দরবারে। ইতিহাস আজও এসবের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। একই সত্যের সিঁড়ি বেয়ে সর্বশেষ মহা সত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক বিশ্বমানবতার সর্বশ্রষ্ঠ বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ঘোর তমাসাচ্ছন্ন সমস্যাসংকুল জাতির সামনে তুলে ধরলেন সার্বিক সমস্যা সমাধানের এক চিরস্থায়ী চির কল্যাণকর অনুপম ব্যবস্থাপনা সম্বলিত জীবনবিধান মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। সত্য যেমন একই ধারায় আবর্তিত হচ্ছিল পক্ষান্তরে মিথ্যাও কোনো কালে কখনো হাত গুটিয়ে সত্যকে অনায়াসে এক পাও এগুতে দেয়নি। শুরু হয়ে গেল প্রিয়নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে অসভ্য জাতির নির্লজ্জ ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার ঝড়।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে তেরটি বছর মক্কা নগরীতে ইসলাম নামক হকের বীজ বপন করলেন বুক ভরা আশা নিয়ে কিন্তু চারা গজালো অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক। তদুপরি তৎকালীন ফরাউন আবু জাহল ও তার গোষ্ঠীবর্গ ঐ চারাগুলি (নব মুসলিম) যাতে বেড়ে উঠতে না পারে তজ্জন্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলতে ছিল বদ্ধপরিকর। আর সেজন্য চালাতে থাকলো নির্যাতনের স্টিমরুলার, বিছিয়ে দিল ষড়যন্ত্রের জাল। নির্মম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নব মুসলিমগণ হতাশার বোঝা মাথায় নিয়ে হাজির হতেন দরবারে নববীত। এমতাবস্থায় রহমতের নবী (সা.) দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে অতীতের নির্যাতিত জাতির ইতিহাস তুলে ধরে তাঁদেরকে ভবিষ্যৎ সুখ স্বপ্নের নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ।

মক্কী যুগর শেষ তিন-চার বছরে ইয়াসরিবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে অপ্রতিহত গতিতে। সেখানকার লাকেরা আরবের অন্যান্য এলাকার গোত্রগুলার তুলনায় অধিকতর সহজ ও নির্দ্বিধায় এ আলো গ্রহণ করতে থাকে। শেষে নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্বের সময় ৭৫ জনের একটি প্রতিনিধিদল রাতের আঁধারে নবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করল, তারা কেবল ইসলাম গ্রহণই করেননি; বরং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে স্থান দেয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন।

অন্যদিক মক্কাবাসীদের কাছেও এ ঘটনাটির তাৎপর্য ছিল সুবিদিত। ইতঃপূর্বে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা.)-এর বিপুল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ যোগ্যতার সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং এখন সেই মুহাম্মদই (সা.) যে, একটি আবাস লাভ করতে যাচ্ছিলেন তা তারা বেশ অনুধাবন করতে পারছিল। এহেন সত্যাভিসারী কাফেলার এ নব উত্থান ছিল পুরাতন ব্যবস্থার জন্য মৃত্যুর ঘণ্টাস্বরূপ। তাছাড়া মদিনার মতো জায়গায় এই মুসলিম শক্তির একত্র সমাবেশ কুরাইশদর জন্য আরও নতুন বিপদের সংকত দিচ্ছিল।

তারপর যখন মুসলমানরা একজন দুজন করে মদিনায় হিজরত করতে থাকলো এবং কুরাইশদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে, এখন মুহাম্মদ (সা.) সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে যাবেন তখন তারা এ বিপদকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য সর্বশষ উপায় অবলম্বনে এগিয় এলো। রাসূল (সা.)-এর হিজরতের মাত্র কয়ক দিন আগে কুরাইশদের পরামর্শ সভা বসলো। অনেক আলাচনা পর্যালাচনার পর সখানে স্থির হলো, বনী হাশেম ছাড়া কুরাইশদের প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে লোক বাছাই করা হবে এবং এরা সবাই মিলে মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করবে।

কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানি এবং নবী (সা.)-এর আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও উন্নত কৌশল অবলম্বনের কারণে তাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেলা। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্বিঘ্নে মদিনায় পৌঁছে গেলেন। এভাবে হিজরত প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা মদিনার সরদার আব্দুল্লাহ ইবন উবাইকে পত্র লিখলো : তোমরা আমাদের লোককে তোমাদের ওখানে আশ্রয় দিয়েছো। আমরা এ মর্মে আল্লাহর কসম খেয়েছি, হয় তোমরা তার সাথে লড়বে বা তাকে সেখান থেকে বের করে দেবে। অন্যথায় আমরা সবাই মিলে তোমাদের ওপর আক্রমণ করব এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা ও মেয়েদেরকে বাতি বানাবো। কুরাইশদের এ উস্কানীর মুখে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কিছু দুষ্কর্ম করার চক্রান্ত এঁটেছিল। কিন্তু সময়মতো নবী (সা.) তার দুষ্কর্ম রুখে দিলেন।

ওদিকে মক্কাবাসীরাও মদিনার দিকে লুটেরা বাহিনী পাঠাতে থাকে। তাদেরই একটি বাহিনী কুরয ইবনে জাবের আল ফিহরীর নেতৃত্বে একেবারে মদিনার কাছাকাছি এলাকায় হামলা চালিয়ে মদিনাবাসীদের গৃহপালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এর দ্বারা তারা মদিনাবাসীদেরকে বুঝিয়ে দিল যে, আড়াই শত মাইল দূর থেকে এসে আমরা মদিনায় তোমাদের ঘরে হানা দিয়ে তোমাদের ধনসম্পদ লুট করে নিতে পারি। আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রচেষ্টা থেকে তারা হাত গুটিয়ে ছিল না। তাছাড়া তারা কেবল ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছিল না, লুটতরাজও শুরু করে দিয়েছিল। এহেন দূর আচরণসমূহ ছিল মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে খোলা চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

নবী (সা.) উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটটি অনুভব করলেন যেন চূড়ান্ত মীমাংসার সময় এসে গেছে । তিনি ভাবলেন এ সময় যদি একটি সাহসী পদক্ষপ গ্রহণ না করা হয় তাহলে ইসলামি আন্দোলন চিরকালের জন্য নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে; বরং এরপর এ আন্দোলনের জন্য হয়ত আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আর কোন সুযোগই থাকবে না। এ কারণে রাসূল (সা.) দঢ় সংকল্প নিলেন যে, বর্তমান যতটুকু শক্তি-সামর্থ্য আমাদের আছে তাই নিয়েই আমরা বের হয়ে পড়বো। কারণ তখন কাফিরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোন অন্তরায় ছিল না, ইতোমধ্যে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে প্রতিরোধ যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। যার বিবরণ পবিত্র কুরআনুল কারীমে লক্ষ্য করুন- যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের সাথে কাফিররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। (সূরা হজ : ৩৯)

হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তনের আদেশ নাযিল হয়। এর কয়েক দিন পরেই শাবান মাস শেষ হওয়ার আগেই রমজানের সাওম ফরয হয়। এমনই সময় কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা যখন সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাছিল এ সংবাদ যথাসময়ে মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট পৌঁছে গেল।

যে কাফেলায় মক্কাবাসীদের প্রচুর ধনসম্পদ ছিল। শুধু উট ছিল এক হাজার। এ কাফেলায় মোট পুঁজি সম্পর্কে ইবন উকবা (রহ.)-এর বিবরণ হলো ৫০ হাজার দীনার। আর দীনার হলো স্বর্ণমুদ্রা। যা আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে প্রায় ২৫ লাখ টাকার সম্পদ। এ সম্পদ বর্তমানে ২৫ কাটিরও বেশি হবে। এই বাণিজ্য কাফেলায় প্রায় সত্তর জন লাক ছিল। তাতে কুরাইশ নতা ছিল ৩০ বা ৪০ জন।

একথাও সবাই জানত যে, কুরাইশদের এই বাণিজ্য এবং বাণিজ্যক এই পুঁজিই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। এরই ভরসায় তারা রাসূল করিম (সা.) ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের উৎপীড়ন করে মক্কা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল। মদনিায় হজিরতের পরও নবীজি ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীরা মদিনার দিকে লুটেরা বাহিনী পাঠাতে থাকে। তাদেরই একটি বাহিনী কুরয ইবনে জাবের আল ফিহরীর নেতৃত্বে একেবারে মদিনার কাছাকাছি এলাকায় হামলা চালিয়ে মদিনাবাসীদের গৃহপালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। সে কারণেই রাসূল (সা.) যখন সিরিয়া থেকে এই কাফেলা ফিরে আসার সংবাদ পেলেন, তখন তিনি স্থির করলেন যে, এখনই কাফেলার মোকাবেলা করে কুরাইশদের ক্ষমতার মেরুদন্ড চূর্ণ করে দেওয়ার উপযুক্ত সময়।

যেহেতু লড়াই ও যুদ্ধের কল্পনাও ছিল না সেহেতু প্রিয়নবী (সা.) কোনরূপ গুরুত্ব প্রদান ও বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়াই ৮ রমজান সোমবার মতান্তরে ১২ রমজান শনিবার মাত্র ৩১৩ জন সাহাবি ও নাম মাত্র বাহন ও অস্ত্রশস্ত্র সাথে নিয়ে কাফেলার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

এবার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা সম্পর্কে একটু জেনে নিই। আমরা জানি অপরাধী মন সব সময়ই দুর্বল। মক্কার কাফিররা মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের স্টিম রুলার চালিয়ে আসছিল বিরামহীনভাবে। তাই তাদের মধ্যে মুসলমানদের পক্ষ থেকে যেকোনো সময় প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান ছিল। ইবন ইসহাক প্রমুখ লিখেছেন, বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় যাতায়াত করতে হয় মদিনার পাশ দিয়ে। আবু সুফিয়ান তাই ভয়ে ভয়ে পথ অতিক্রম করছিল।

সিরিয়ার বিখ্যাত স্থান আইনে যোরকায় পৌঁছে কোন এক লোক কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ানকে এ সংবাদ জানিয়ে দিল যে, রাসূল (সা.) তাদের এ কাফলার জন্য অপক্ষা করছেন। তিনি এর পশ্চাদ্ধাবন করবেন। আবু সুফিয়ান সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করল। সাথে সাথে ২০ মিসকাল স্বর্ণ অর্থাৎ ২০০০ টাকা মজুরি দানের মাধ্যমে দমদম ইবনে ওমরকে দিয়ে বাণিজ্য কাফেলা লুণ্ঠন হওয়ার আশঙ্কাজনক সংবাদ মক্কায় প্রেরণ করে ও অতিদ্রুত কাফেলা রক্ষার্থে সদলবলে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়।

সংবাদ নিয়ে অতিদ্রুত অগ্রসর হলো দমদম ইবনে ওমর মক্কাভিমুখে। তা যেন ছিল যমদূতের হাতছানি অর্থাৎ দমদম যেন কুরাইশদের উদ্দেশ্য তাদেরই মৃত্যু ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। মক্কায় সহসা ভেসে এলো একটি ঘোষণা। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, সামনের উপত্যকায় কান ছিদ্র করা গদি উল্টো করে বাঁধা উটের পাশে ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত দমদম চিৎকার করে বলে চলেছে, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! হে লুয়াই বিন গালিব! তোমাদের বাণিজ্য বহরের সংবাদ শ্রবণ করো। আবু সুফিয়ান তোমাদের বাণিজ্য বহর নিয়ে মক্কার দিকে আসছে। আর তা লুণ্ঠনের জন্য পেছনে পেছনে এগিয়ে আসছে মুহাম্মদ ও তার বাহিনী। মনে হয় তোমাদের সম্পদ আর হস্তগত করতে পারবে না।

কুরাইশরা খুব দ্রুত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল । কুরাইশদের প্রায় সমস্ত নেতৃবৃন্দ ১০০০ সৈন্য ২০০ ঘোড়া ৬০০ বর্ম ও সেনাদলের সাথে যাওয়ার জন্য গায়িকারাও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তৈরি হলো।

৬২৩ খ্রি: ২৩ জানুয়ারি কুরাইশগণ মদিনাভিমুখে যাত্রা শুরু করল । মক্কা থেকে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে মুশরিকরা কা’বা শরিফের পর্দা দুহাতে আঁকড়ে ধরে দু‘আ করেছিল, হে আল্লাহ! উভয় দলের মধ্যে যে দলটি ভালো তাকে বিজয় দান করো। আর আবু জাহল বিশেষ করে বলেছিল, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দলটি সত্য পথে আছে তাকে বিজয় দান করো এবং যে দলটি জুলুমের পথ অবলম্বন করেছে তাকে লাঞ্ছিত করো। আত্মঘাতি প্রার্থনা শেষে কুরাইশরা যোদ্ধার বেশে রওনা হলো ।

অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাফেলা যখন বদরের নিকটবর্তী সাফরা মতান্তরে যাফরান নামক উপত্যকায় পৌঁছে, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জানালেন কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য বহর রক্ষা ও মুসলমানদের মোকাবিলার জন্য মক্কা থেকে ১০০০ সশস্ত্র সৈন্য যুদ্ধের জন্য ধেয়ে আসছে।

কুরাইশ বাহিনীর দুনিয়া কাঁপানো অহংকারী আস্ফালন, মাদকের নোংরামি, সাথে থাকা রণবাদ্য ও গায়িকাদের রণসংগীতের অগ্নিঝরা ঝঙ্কার, ইসলাম আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদের ঝড় তুলে উত্তেজিত রক্তচক্ষু নিয়ে আত্মম্ভরিতায় ভরা কুরাইশ বাহিনী হাজির হলো একেবারে বদর রণাঙ্গনের কিনারে।

কুরাইশ বাহিনী উপত্যকার দূরপ্রান্তে আকানকাল/আজানকাল টিলার অপর পাশে গিয়ে শিবির স্থাপন করে। কুরাইশদের ভূমি ছিল নিচু। বদর ও আকানকালের মধ্যবর্তী মরুময় উপত্যকাটি ছিল অসমতল যার পশ্চাতে ছিল কুরাইশরা। উপত্যকার নাম বাতনে ইয়ালীল। বদরের কূপের অবস্থান ছিল নিকট প্রান্তে। বদরের পানির কূপটি অধিকার করে বসলো মুশরিক বাহিনী।

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বদরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। বদরের যেখানে নবী (সা.) অবতরণ করেছিলেন সেখানে মুশরিকরা বদর ময়দানের পানি দখল করে নিয়েছিল এবং মুসলমান ও পানির মাঝখানে তারা প্রতিবন্ধকরূপে দাঁড়িয়ে ছিল। মুসলমানরা দুর্বলতাপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন। পানির অভাবে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা। চারিদিকে কেবল ধু-ধু বালুকারাশি। পানির অভাবে পানাহার, ওজু গোসল- সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলো তাঁদের । মুসলমানগণ পড়ে গেলেন বিপাকে।

তাঁদের আহাজারি ও তপ্ত নিঃশ্বাস উদগীরণ হচ্ছিল প্রবল ঝড়ের গতিতে সুমহান প্রভুর দরবারে। মুমিনদের এহেন চরম সংকট মুহূর্তে সুযোগ বুঝে শয়তান তাদেরকে এই মর্মে কুমন্ত্রণা দিলো যে তোমরা না বিশ্বাসী! তোমরা না আল্লাহর প্রিয় পাত্র! তোমাদের রাসূলও তো রয়েছেন তোমাদের সঙ্গে। অথচ দেখো যাদেরকে তোমরা মন্দ বলো, সেই মুশরিকই পেয়েছে পানির অধিকার। তাহলে ভেবে দেখ আল্লাহর প্রিয় পাত্র কারা? তোমরা না তারা?

আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাসীদেরকে শয়তানের এই কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করলেন। এই রাতেই শুরু হলো মুষলধারায় বৃষ্টি। আর বৃষ্টির ফলে মুসলমানদের অবস্থান হয়ে উঠলো অধিকতর স্বচ্ছন্দ। নিম্নভূমিতে জমে রইলো প্রচুর পানি। মুসলমানগণ সেই পানি দিয়ে নিজেদের এবং পশুপালের সকল প্রয়োজন পূর্ণ করলেন। কিন্তু এই প্রবল বারিপাত মুশরিকদের অবস্থানকে করে তুললো বিপর্যস্ত। তাদের চারপাশ হয়ে উঠলো কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। ওই রাতে ঘটলো আর একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। আল্লাহপাক তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলেন এক অপার্থিব তন্দ্রা। ফলে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তারা। ওই তন্দ্রা ছিলো আল্লাহপাকের বিশেষ রহমতের এক অলৌকিক বর্ষণ। সারারাত ধরে প্রবল বৃষ্টিপাতে সিক্ত ও শীতল হয়ে উঠেছিলো বাইরের মৃত্তিকা। আর সাহাবিগণের হৃদয় ও চেতনা পূর্ণরূপে সিক্ত ও প্রশান্ত হয়ে উঠেছিলো আল্লাহপাকের অপার রহমতের অলৌকিক বর্ষণে। নিদ্রারূপী সেই রহমতের সমুদ্রে তাই সারারাত নিমগ্ন ছিলেন তারা।

রাসূল (সা.) আল্লাহ তা‘আলার দরবারে প্রার্থনা জানালেন, হে আমার আল্লাহ! আজ এই বদর প্রান্তরে তুমি যদি বিশ্বাসীদের এই ক্ষুদ্র দলটিকে ধ্বংস করে দাও। তবে ভূ-পৃষ্ঠে তোমার ইবাদতকারী আর কেউ থাকবে না। প্রার্থনা শেষ হলো। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল এবং মুসলিম বাহিনীর সাহায্যার্থে হজরত জিবরাইলের নেতৃত্বে প্রথমে প্রেরণ করেছিলেন এক হাজার ফেরেশতার একটি দল। তার পাঁচশত সেনার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন হজরত জিবরাইল এবং অবশিষ্ট পাঁচশতের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন হজরত মিকাইল। বিপক্ষ দল যদি প্রচণ্ড আক্রমণ করে বসে, তবে পাঁচ হাজার ফেরেশতার সাহায্য পাঠানো হবে বলে আশ্বাস প্রদান করা হয়।

যুদ্ধ বাধার পূর্ব মুহূর্তের চিত্রটা ছিল এরকম যে, তখন দুটি বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি। দুটি দল একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রস্তুত। দয়াময় আল্লাহর সামনে দুটি বিবাদমান পক্ষ উপস্থিত। এদিকে নবীকুলের সরদার তার প্রতিপালকের কাছে সাহায্য লাভের ফরিয়াদে রত। সাহাবিগণ বিভিন্ন প্রকার দু‘আ-মুনাজাতের মাধ্যমে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন সেই সত্তার কাছে, যিনি ভূ-মণ্ডল ও নভমণ্ডলের একচ্ছত্র মালিক। মানুষের দু‘আ শ্রবণকারী ও বিপদ থেকে মুক্তিদানকারী।

উভয় পক্ষ যখন যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হয়, তখন আবু জাহল এই দু‘আ করে, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল সত্যের ওপর আছে, সে দলকে সাহায্য করুন। বদর যুদ্ধটি ২য় হিজরির ১৭ই রমযান শুক্রবারে সংঘটিত হয়। যা ছিল কুফুরী শক্তির মূলে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রথম মরনাঘাত । মুখোমুখী হয়ে শক্তি পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে গেল উভয় বাহিনী।

প্রথানুযায়ী প্রথমে মল্ল যুদ্ধের জন্য উতবা আহ্বান করল মুসলমি বাহনিীকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) উবায়দা ইবনে হারিস, হামযা ও আলি (রা.)-কে তাদের মোকাবিলায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সব চাইতে বয়স্ক মুজাহিদ উবায়দা (রা.) উতবা ইবনে রবীআর বিরুদ্ধে, হামযা (রা.) শায়বার বিরুদ্ধে এবং আলি (রা.) ওয়ালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। হামযা (রা.) শায়বাকে এবং আলি (রা.) ওয়ালিদকে পাল্টা আঘাত হানার সুযোগই দিলেন না। প্রথম আঘাতেই তাদের হত্যা করলেন। আর উবায়দা (রা.) ও উতবা উভয়ে একটি করে আঘাত বিনিময় করে, একে অপরকে আহত করলেন। হামযা ও আলি দ্রুত ছুটে গিয়ে নিজ নিজ তরবারির আঘাতে উতবাকে হত্যা করলেন। এরপর তারা উবায়দা (রা.)-কে কাঁধে তুলে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে পৌঁছে দিলেন।

এরপর রাসূল (সা.) কর্তৃক পাথর কণা নিক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হল যেভাবে: হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এক মুঠো মাটি নিয়ে শত্রুদের প্রতি ছুঁড়ে মারুন। রাসূল (সা.) তাই করলেন। ওই মাটি নিক্ষিপ্ত হলো সকল শত্রুর চোখে, নাকে ও মুখে। মতান্তরে রাসূল (সা.) হজরত আলিকে বললেন, আমাকে এক মুঠো কঙ্কর দাও। সঙ্গে সঙ্গে হজরত আলি কঙ্কর এনে দিলেন। রাসূল (সা.) সেগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে কাফিরদের দিকে ছুড়ে মারলেন। প্রতিটি নিক্ষেপের সময় তিনি (সা.) উচ্চারণ করছিলেন শাহাতিল উজুহ। ফলে তাদের মধ্যে এমন কেউই অবশিষ্ট রইলো না, যাদের চোখে কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হয়নি। ফলে তারা হয়ে পড়লো দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য। কিছুক্ষণ যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও পলায়ন ছাড়া তাদের আর কোনো গত্যন্তর রইল না। রাসূল (সা.) সাহাবিদেরকে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন, আক্রমণ করো। আক্রমণ করো। শুরু হলো প্রচণ্ড আক্রমণ। একে একে নিহত হতে শুরু করল কুরাইশ নেতারা। কেউ কেউ হয়ে গেলো বন্দি।

বদরের দিন শয়তান স্বীয় পতাকা ও সেনাবাহিনী নিয়ে মুশরিকদের দলে যোগদান করেছিল এবং তাদের অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে, কেউই তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। সে তাদেরকে আরও বলেছিল, “তোমাদের কোনোই ভয় নেই, আমি তোমাদের সাহায্যার্থে সর্বদা তোমাদের সাথেই থাকব। কিন্তু যখন উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং সেই পাপাচার শয়তান ফেরেশতাদেরকে মুসলিমদের সাহায্যার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে দেখলো তখন সে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাতে শুরু করল এবং বলতে লাগলো: আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাও না। প্রকৃত পক্ষে শয়তানের অঙ্গীকার ধোঁকা আর প্রতারণা বই কিছুই নয়।

যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অপেক্ষায় মুসলিম জগৎ সকলেই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলেন, এখন সেই কুরাইশ মুশরিকদের দাম্ভিক সেনাপ্রধান আবু জাহলের হত্যার করুণ কাহিনি ও অশুভ পরিণতির এক কালো অধ্যায় আপনাদের সামনে তুলে ধরছি-
আব্দুর রহমান বিন আওফ হতে বর্ণিত আছে যে, ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমি সৈন্যদের সারিতে ছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ ডানে এবং বামে অল্প বয়স্ক দুজন যুবক আমার কাছে এসে বলল: ‘চাচাজান আবু জাহল কোনটি আমাকে দেখিয়ে দিন। ‘দ্বিতীয় জনও এসে ইঙ্গিতে আমাকে ঐ একই কথা বলল। তাদরে নাম হলো- ১) মুআয বিন আমর বিন জামুহ এবং ২) মুআয বিন আফরা।

আমি বললাম, ‘ভাতিজা’ তাকে তোমাদরে কী প্রয়োজন।’ সে বলল, ‘আমাকে বলা হয়েছে যে, সে রাসূলুল্লাহকে মন্দ বলেছে। সেই সত্তার কসম! যার হাতে রয়েছে আমার জীবন, যদি আমি তাকে দেখতে পাই তাহলে যতক্ষণ আমাদের মধ্যে যার মৃত্যু পূর্বে অবধারিত হয়েছে সে মৃত্যুবরণ না করবে ততক্ষণ আমার অস্তিত্ব তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক হবে না।’

তিনি বলেছেন যে, আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, আবু জাহল লোকজনদের মাঝে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বললাম আরে দেখছ না, ঐ যে, তোমাদের শিকার যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলে।’

এ কথা শোনামাত্র তারা উভয়ে তরবারি নিয়ে লাফ দিয়ে এগিয়ে চলল । মুআয বিন আমর বিন জামুহ বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি যখন আবু জাহলকে আঘাত করলাম অন্য দিকে তখন তার ছেলে ইকরামা আমার কাঁধে তরবারির আঘাত করল এবং তাতে আমার হাত কেটে গিয়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে গেল এবং যুদ্ধের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। আমি তাকে পিছনে টেনে নিয়ে সাধারণভাবে যুদ্ধ করতে থাকলাম কিন্তু সে যখন আমাকে খুবই কষ্ট দিতে লাগল তখন আমি তার ওপর আমার পা রেখে জোরে টান দিয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম হাতটিকে।

এরপর আবু জাহলের নিকট পৌঁছে যান মুআয বিন আফরা। তিনি তাকে এত জোরে আঘাত করেন যে, তার ফলে সে সেখানেই স্তূপে পরিণত হয়ে যায়। সে সময় শুধু তার শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু অবশিষ্ট ছিল। এরপর মুআয বিন আফরা যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হয়ে যান।

যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘কে আছ এমন যে, দেখে আসবে আবু জাহলের অবস্থা কি হলো। এ কথা শুনে সাহাবিগণ (রা.) তার খোঁজে বিক্ষিপ্তভাবে নানাদিকে চলে গেলেন। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ তাকে এমন অবস্থায় পেলেন যে, তখনো তার শ্বাস-প্রশ্বাস যাওয়া আসা করছিল। তিনি তার গ্রীবার ওপর পা রেখে মাথা কেটে নেয়ার জন্য দাড়ি ধরলেন এবং বললেন, ‘ওহে আল্লাহর শত্রু! শেষে অল্লাহ তোমাকে এভাবে অপমানিত করলেন? সে বলল, ‘আমাকে কী প্রকারে লাঞ্ছিত করলেন?’ যে ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন লোক কেউ আছে কি? অথবা যে লোকটিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উঁচু সম্মানের কোনো লোক আছে কি? তারপর সে বলল, যদি আমাকে কৃষকরা ছাড়া অন্য কেউ হত্যা করত তবে কতই না ভালো হতো! তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে বলতো আজ বিজয় কার হয়েছে?’ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.)-এর।’ তারপর সে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে বলল, যিনি তার গ্রীবার ওপর পা রেখে ছিলেন, হে বকরির রাখাল! তুমি বড়ই উঁচু ও কঠিন জায়গায় চড়ে গিয়েছো। প্রকাশ থাকে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ মক্কায় বকরি চরাতেন।

এ কথোপকথনের পর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ তার মস্তক কেটে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে নিয়ে গিয়ে হাজির করে দিলেন এবং আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! এটা আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের মস্তক। তিনি আরও বলেন, আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এত দ্রুত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আসলাম, মনে হলো যেন জমিন আমার জন্য সংকুচিত হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনবার বললেন, ‘সত্যইি, ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া অন্য কোনো মা’বুদ নেই।’ তারপর বললেন, আল্লাহ সবচেয়ে মহান। ঐ আল্লাহর সমুদয় প্রশংসা যিনি তার ওয়াদাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত দলকে পরাজিত করেছেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘চলো আমাকে তার মৃতদেহ দেখাও।’ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি তাকে নিয়ে গিয়ে তার মৃতদেহ দেখালাম. তিনি বললেন, ‘ঐ ব্যক্তি এ উম্মতের ফিরাউন।

আবু জাহল ছিল হালকা পাতলা গড়নের। কিন্তু তার চাহনি ছিল তীক্ষ্ণ, ভাষা ছিল ধারালো ও বলিষ্ঠ। বদরের নিহতের মধ্যে আবু জাহল ৬৯ (উনসত্তর) নম্বরে ছিল। রাসূল (সা.) বন্দিদের সাথে নিয়ে বিজয়ীবেশে মদিনার দিকে রওনা হলেন। পথিমধ্যে আরকুয-যাবিয়াতে পৌঁছে উকবা ইবনে আবু মুআইতকে হত্যা করা হয়। এভাবে ৭০ পূর্ণ হয়।

বদর যুদ্ধে নিহত কাফিরদের সংখ্যা ছিল সত্তর। আর বন্দিদের সংখ্যাও ছিল অনুরূপ। শহিদ সাহাবির সংখ্যা চৌদ্দ। ছয়জন মুহাজির এবং আটজন আনসার। আনসারদের মধ্যে আবার ছয়জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের এবং অবশিষ্ট দুজন আউস গোত্রের। রাসূলে পাক (সা.) কুরাইশদের নিহত সত্তরটি লাশের মধ্যে চব্বিশটিকে বদরের একটি কূপে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কূপটিতে ওই এলাকার ময়লা-আবর্জনা ও নাপাক বস্তু ফেলা হতো। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ও শত্রুতা পোষনকারীদের সর্বকালে এহেন অশুভ পরিণতি নির্ধারিত।

যুদ্ধ শেষে হজরত মুয়াজ তার কর্তিত হাতটি নিয়ে রাসূল (সা.) সকাশে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সা.) তাঁর পবিত্র মুখের লালা দিয়ে হাতটি জোড়া লাগিয়ে দিলেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমানের খেলাফতের সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন হজরত মুয়াজ।

মজার বিষয় হলো এই যে, মক্কার মুশরিকরা ধারণা করত যে, তারা সত্য ও সঠিক পথে আছে। আর সে কারণে বদর যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে কা’বা শরিফের গিলাফ ধরে তারা সত্যের বিজয়ের জন্য দু‘আ করেছিল। আবার মুসলমানরাও সত্য পথের দাবিদার ছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত বদর নামক প্রান্তরে মুসলমান ও কাফিরদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আল্লাহ তা‘আলা সত্য ও মিথ্যার সুস্পষ্ট পার্থক্য ঘটিয়ে দিলেন আর দেখিয়ে দিলেন কারা সত্য পথে আছে। যেন সত্যের দীর্ঘদিনের বন্ধ দুয়ার উন্মোচিত হলো। মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে একটি পার্থক্য রেখা টেনে দিলেন। আর ঘোষণা করলেন যে বদর যুদ্ধের এই দিনটিই সত্য ও মিথ্যার ফয়সালা তথা পার্থক্য নিরূপণের দিন। বস্তুত আল্লাহ তাদের নিজ মুখে উচ্চারিত আবদার অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করলেন এবং দুই দলের মধ্যে কোনটি ভালো ও সত্যপন্থি তার মীমাংসা করে দিলেন। এটাই ছিল জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশার আঁধার চিরে মুসলিম বিজয়ের শুভ সূর্যোদয়।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর